বিজয়া দশমী

“ও মা, ঠাকুর বরণ করে এলে বুঝি?”

“হ্যাঁ রে। তোর কথা বড্ড মনে পড়ছিল। তোর সব বন্ধু বান্ধবীরা এসেছে, শুধু তুই ই কত দূরে। তোর সেই স্কুল এর বন্ধু , রিয়া, মনে আছে তোর? ও ও এসেছিল, একেবারে লাল হলুদ শাড়ী পরে। যা সুন্দর লাগছিল যে তোকে কি বলব। সিঁদুর খেলে তো তার মুখ এত লাল, এত সুন্দর! জানিস, তুই ও যখন আমার ওই লাল বেনারসিটা পরে কলেজের নাটকে কনে বউ সেজেছিলি, আমার যে তোকে দেখে কি আনন্দ হয়েছিল কি বলবো!”

“আচ্ছা মা, এবারে কটা ঠাকুর দেখলে?”

“তুইই বল কলকাতায় কি কম ঠাকুর আছে? এতো কে দেখতে যাবে বল। আমার হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে আজ আর নড়তেই পারিনা। তোর বাবা জোর করে নিয়ে গেল আমাদের বাড়ির পেছনের প্যান্ডেলে। তারপর আর একটা দুটো।”

“মোটে এই কটা? আমি নেই বলে আর বেরোয় ও নি সেভাবে। কি আশ্চর্য মানুষ বলো তো তোমরা। উফ তোমাদের নিয়ে আর পারিনা।”

“যাই হোক, নতুন শাড়ী পরে গেছিলে তো? ও হ্যাঁ, কটা নতুন শাড়ী, জামা কাপড় কিনলে কিছুই বললে না আমায়। আর আমিও সময় পাই না, সারা দিন কাজ আর কাজ। হয় অফিস নয় বাড়ি।”

“সে তো আমি জানি রে, রুনু। তোর খুব কষ্ট হয়। কি করবি বল, মেয়েমানুষেরা শুধু পৃথিবীতে খাটতেই আসে।” বলেই শীলাদেবীর দীর্ঘশ্বাস পরে।

“যেটা জিগেস করলাম, সেটা বললে না; না বলে একশো বছরের বুড়িদের মতো কথা বলে যাচ্ছ।”

“ওই একটা গেঞ্জি কিনেছি তোর বাবার জন্যে, নীল রঙের, মানিয়ে গেছে তোর বাবাকে। তার যা গায়ের রং, তাতে ওই নীল কালো ছাড়া কি মানায় বল। আর বয়স তো কম হলো না, পঁয়ষট্টি হয়ে যাবে সামনের শ্রাবণে।”

“হুম। বুঝলাম বাবার মোটে একটা জামা, আর তোমার? আমি যে টাকা দিলাম, সেগুলো দিয়ে কি করলে?”

“আমি ঐ গড়িয়াহাট থেকে একটা ছাপা শাড়ী কিনেছি, একটু দামি, এই সাড়ে ছ’শো মতো পড়লো। আসলে তোর বাবার রোজগারটাও তো কমে আসছে, অহেতুক খরচ খরচা আর করি না। তাছাড়া এই তোর বাবার শরীরটাও ভেঙে যাচ্ছে, এত রোগা হয়ে গেছে কি বলবো। পই পই করে বলি, যাও একটু ব্লাড সুগার আর লিপিড প্রোফাইলটা চেক করিয়ে এসো, কিন্তু শুনবে আমার কথা বল। শুধু দিন রাত সিগারেট, তার বেলা যদি একটুও কমতো।”

“আমি কোনো কথা শুনবো না, মা: তোমরা দুজনে কালই যাবে হেল্থ চেক আপ করাতে, মেডিক্লেমে এত টাকা দাও প্রত্যেক বছরে তাও ডাক্তার দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চেক আপ করাও না। তা তুমি হাঁটুর ব্যথার ওষুধটা খাচ্ছ তো?”

“খাচ্ছিলাম, ওই দুদিন আর খাওয়া হয় নি, শেষ হয়ে গেছে …”

“আর তাই তোমার হাঁটুর ব্যাথা বেড়েছে আর ঠাকুর দেখাও লাটে উঠেছে।”

শীলাদেবী চুপ করে গেলেন, মেয়ের কাছে খুব ধরা পড়ে গেছেন। তাও যে মেয়ে টের পায়নি যে তিনি বিজয়া দশমীতে ঠাকুর বরণ করতে যাননি, তাই স্বস্তি। নয়তো আরো বকা খাওয়া অনিবার্য ছিল। বেশ বুঝতে পারছেন যে ফোনের অন্য প্রান্তে তার কন্যার মেজাজ পঞ্চমে চড়ে গেছে। কি বলে যে তাকে শান্ত করবেন, তা ভেবে উঠতে পারছেন না।

“ওগো শুনছো, একটু চা করো। আমি বেরোব একটু পর।”

চায়ের হুকুম শুনে ষাট ছুঁইছুঁই শিলাদেবীর মাথা গেল গরম হয়ে। যেই মেয়ের সাথে একটু কথা বলতে আরম্ভ করেছি অমনি বুড়োর চা দরকার। আর পারিনা!

“তুই অত চিন্তা করিস না রে, আমরা দিব্বি আছি দুই মানুষে। এখন পুজোর সময় কি আর ডাক্তার পাওয়া যায়, লক্ষী পুজোটা হলেই সব করে নেব। আর হাঁটুর ব্যথার ওষুধটা আজই বলছি তোর বাবাকে এনে দিতে। ভাগ্গিস মনে করিয়ে দিলি!”

যাক, এবার যদি তাঁর রুনু মা একটু শান্ত হয়।

“ওগো শুনছো, কত বার বলছি, চা করে দাও, কথা আর শুনতে পাচ্ছ না। শুধু ফোনে কথা বলে যাচ্ছ। তা কার সাথে এত বকবক করছো বলো তো!”

“তোমার মেয়ের সাথে। এবার একটু থামো তো, সারা দিন শুধু চা চা করে যাও। একটু কথা বলে নি, তারপর চা খাবে। এত বয়স হলো তাও একটা চা বানিয়ে খেতে পারোনা। পারি না আর তোমাকে নিয়ে। আমি মরে গেলে কি খাবে কে জানে!”

স্ত্রীর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন শৈলেন বাবু।

“এসব কি বকে যাচ্ছ, শীলা?”

“সপ্তমীর দিন তোর বাবা একটা বড় ভেটকি মাছ নিয়ে এসেছিল। এসে কি বলে জানিস, বলে বিবাহবার্ষিকী তো আর আজকাল মনে থাকে না, তাই আর তোমার জন্যে ভালো কিছু আনতেও ভুলে যাই, আজ ভেটকিটা দেখেই আমাদের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই যে তুমি বিয়ের দিন ই আমার পাত থেকে আস্ত ভেটকির পাতুড়িটা খাবলে নিয়ে নিয়েছিলে, তা আর কি ভুলতে পারি! সেদিন আমি রাগব না হাসব, ভেবেই পাচ্ছিলাম না।”

“ও শীলা, তুমি কার সাথে কথা বলছ?”, অস্থির গলায় শৈলেনবাবু শিলাদেবীর হাতটা টেনে জিজ্ঞেস করেন।

“জানিস রুনু, সেই কথা শুনে আমার তো হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গেল। তারপর মাছটাকে ভালো করে কাজু বাদাম বাটা আর কিশমিশ বাটা দিয়ে ঝাল করলাম, ঠিক তুই যেমন খেতে ভালোবাসিস।…”

আর ধৈর্য্য না রাখতে পেরে শৈলেনবাবু ফোনটা কেড়ে নিলেন। দেখলেন ফোনের ওপারে কেউ নেই। কল লিস্ট খুলে দেখলেন, শুধু সেই দিনই অন্তত গোটা চার পাঁচেক বার ফোন করা হয়েছে রুনুর ফোন নাম্বারে। কেউ ধরেনি ওই ফোনগুলো।

“কাকে ফোন করে চলেছ, শীলা? সে যে আর আসবে না। সে তো চলে গেছে সারা জীবনের মতো। আমাদেরই ভুল হয়েছিল ওর বিয়ে দিয়ে। ওর ভাল হবে ভেবেই রমেনের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম। তখন কি আর জানতাম যে ছয় মাসেই মেয়েটা শেষ হয়ে যাবে ওদের লোভের বলি হয়ে!”

কথাগুলো বলতে বলতে রুনুর বৃদ্ধ বাবার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে থাকে। মা দুগ্গাও আসেন বাবা মায়ের কাছে বছরে একবার করে, শুধু তাঁদের মেয়েই আর আসে না।

সেই ফাঁকে রুনুর মা আরো একবার চেষ্টা করেন যদি তাঁর মেয়েটাকে ফোনে পাওয়া যায়, যদি একবার রুনু আসে তাঁর হাতের বিজয়া দশমীর নারকেল নাড়ু খাওয়ার জন্যে…

12 thoughts on “বিজয়া দশমী

    1. Ki odvut, amake kintu thik thak spelling tai dekhacche. Ami mobile e google indic keyboard use kore bangla type kori. Mobile e toh thik e dekhay. Laptop e bangla type korar chesta korini kono din.

      Like

Leave a reply to Maitrayee Ghosh Cancel reply